Skip to main content



রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি জাতি গোষ্ঠী যারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের দক্ষিন-পূর্ব জেলা বান্দরবান ও কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী রাজ্য। এক সময় এই রাজ্যটি নাম ছিল রোসাঙ্গা। পরে এর নামকরণ করা হয় আরাকান। আর ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারে নামকরণে বড় ধরণের পরিবর্তন আসে। তখন ‍ বার্মা থেকে মিয়ানমার করা হয় এবং একই সাথে আরাকান থেকে রাখাইন করা হয়।
রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গারা কয়েক শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশির ভাগই মুসলমান তবে তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যাক হিন্দুও রয়েছে। রাখাইন রাজ্যটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত স্বাধীন একটি রাজ্য ছিল। কিন্তু ১৭৮৪ সালে বার্মা রাজা তৎকালীন আরাকান দখল করলে এটা বার্মার অধীনে আসে। পরে ১৮২৩ সালে ব্রিটেন মায়ানমার দখল করলে আরাকানও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৩৮-৪২ সালে প্রথম আরাকানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। তখন বার্মার বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের উপর হামলা চালায়। তখন জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাংলাদেশে আসে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে জাপানিদের সহযোগীতায় মিয়ানমারের বৌদ্ধরা ৫,০০০ রোহিঙ্গাদের হত্যা করে। তখন রোহিঙ্গারাও ব্রিটেনের সহায়তায় ২০,০০০ মগদের হত্যা করে। বিশ্বযু্দ্ধের সময় রোহিঙ্গাদের ভূমিকার জন্য মিয়ানমারের সরকার ও বৌদ্ধরা তাদের আরও বেশি ঘৃনা করে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে মিয়ানমার অভিযোগ করে যে রোহিঙ্গারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ করেছে। মিয়ানমার এই উদ্যোগকে বিশ্বাসঘাতকার সাথে তুলনা করে।
১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সময় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকদের মর্যাদাসহ সকল সুযোগ সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। তবে যেগুলো শুধু মুখের বলি হয়ে তাকে বাস্তবে রোহিঙ্গাদের জন্য সামান্য সুযোগ সুবিধা ছিল। ১৯৫৮ সালে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা আবারও রোহিঙ্গাদের হত্যার অভিযান চালায়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক সরকার ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি দমন শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সময় কিছু সংখ্যাক বাংলাদেশি আরকানে আশ্রয় নেয়। তবে এই সংখ্যা বেশি নয়। আর যারা গিয়েছিল তাদের কিছু অংশ থেকে গেলেও বড় অংশই চলে আসে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার  অপারেশন নাগমিন ড্রাগন নামে রোহিঙ্গাদের নিমূর্লের জন্য একটি অভিযান চালায়। সেই অভিযানে ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে।
১৯৮২ সালে মিয়ানমার তিন ধরণের নাগরিকত্ব চালু করে। ১. পূর্ণাঙ্গ ২. সহযোগী ৩. অভিবাসী। রোহিঙ্গাদের সহযোগী নাগরিকত্ব দেওয়া হয় কিন্তু অন্যদের নাগরিকত্বের কার্ড দিলেও রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয় নি। ফলে তারা যেকোন নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হল। আর সহযোগী নাগরিকত্বের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তারা অনুমতি ছাড়া বিয়ে, চলাচল, পড়ালেখা করতে পারত না। রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা জন্ম নিয়ন্ত্রন আইন করা হয়। ১৯৯১ সালে আরাকারে বাইরে থেকে মগদের এনে তাদের জন্য বসতি স্থাপন করে। এটা নিয়ে ১৯৯১ সালে আবারও রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়।
পরে ২০০১ রোহিঙ্গা ও মগদের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। এরপর ক্রমাগতভাবে সরকারী হস্তক্ষেপে আরাকারে মগদের বসতি বাড়তে থাকে। তবে ২০১২ সালে এক মগ নারীকে ধর্ষনের অভিযোগে ৮জন রোহিঙ্গাদের মগরা পিটিয়ে হত্যা করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় ও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৬ সালের জুনের দিকে আবার রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয় ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য তখন সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সমঝোতায় সাবেক জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে নয়  একটি রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশন গঠন করা হয়। নয় সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে কফি আনান ছাড়া আরও ছিলেন মিয়ানমারের ৬জন, নেদারল্যান্ডস ও লেবাননের একজন সদস্য। এই কমিটি গত এক বছরে মিয়ানমারের সিটওয়ে, মংডু, বুথিডং, ইয়াঙ্গুন, নেপিদো ছাড়াও ব্যাংকক, ঢাকা, কক্সবাজার ও জেনেভায় অন্তত ১৫৫টি বৈঠক করে প্রায় ১ হাজার ১০০ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, লোকজনের অবাধ চলাচল ও নাগরিকত্ব আইনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের ২০টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। এতে ১২ জন পুলিশ ও ৭৭ জন হামলাকারী নিহত হয়। এই ঘটনার পর মিয়ানমার সরকার ও স্থানীয় বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমন চালায়। গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি চালিয়ে দেওয়া হয়, নারীদের ধর্ষণ করা হয় ও কমপক্ষে ৫০০০ পুরুষদের হত্যা করা হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ও কৌশল ছিল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া তাই তারা ভয়-ভীতি ও গুলি করে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে তাদের ঠেলে দেয়। ২৫ আগস্টের পর অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে 
রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরণের সমস্যা। কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১০ লাখ রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এছাড়া বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিষয়টিও এর সাথে জড়িত। এছাড়া কক্সবাজার বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটক এলাকা এই এলাকায় যদি রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ে তবে সেখানকার পরিবেশও ভীষণভাবে নষ্ট হবে। এটা মিয়ানমার সরকারের সৃষ্ট একটি জাতিগত নিধন যা জাতিসংঘের মানবাধিকার অনুসারে গণহত্যার সামিল। মিয়ানমার সরকারের অন্যায়মূলক কাজের ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হল বাংলাদেশ। আর এই সমস্যার জন্য সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমার দায়ী।

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকা শহরের নদী দূষণের ফলাফল (৩য় পর্ব)

আমাদের ঢাকা শহরের চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বে এমন রাজধানী বিরল। এক সময় ঢাকা শহরে ছিল পরিবেশ বন্ধব। অনেক গাছপালা ছিল আর ঢাকা শহরের ভিতরের ছোট ছোট খালগুলো ছিল দূষণমুক্ত। মানুষ আরামে বসবাস করতে পারত। বর্তমানে সেই নদীগুলোকে ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু প্রাণহীন এই নদীগুলো ধ্বংস হলে আমাদের কি কোন ক্ষতি হবে না? নদীগুলো হত্যা করে আমরা কি শান্তিতে বাচতে পারব? না, নদীগুলো ধ্বংস করে আমরা শান্তিতে বাচাতে পারব না। কারণ এই নদীগুলো ছিল আমাদের জীবনকে সুন্দর করার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ না থাকলে বা বিপন্ন হলে মানব জীবনে ও পরিবেশের উপর এর ফলাফল কি হবে পারে তাই আমরা এ পর্বে আলোচনা করব।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর অবস্থা (১ম পর্ব)

ভূমিকা:  ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। মাত্র ৫৯০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এই শহরকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ মানুষ শহরে আসা যাওয়া করে। আর বাংলাদেশের সব কিছু প্রানকেন্দ্র ঢাকা শহর। তাই প্রতিনিয়তই গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এভাবেই দিনদিন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলছে। ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ রাজধানী। বিরামহীনভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এক কালের সুন্দর ঢাকা শহর আজ পরিনত হয়েছে অপরিকল্পিত ও দূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যেভিক্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর হল ঢাকা।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর রক্ষা সুফলগুলো (৫ম ও শেষ পর্ব)

আমরা যদি বিশ্বে মানচিত্রের দিকে তাকাই তবে দেখব বিশ্বের সব গুরুত্বপূণ শহরগুলো নদী কিংবা সমুদ্রের তীর অবস্থিত। আমরা যদি এবার ইতিহাসে দিকে তাকাই তবে দেখব সেসব শহরের পাশে নদী আছে সেই সব শহরগুলো অন্য শহরগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ এটা যোগাযোগ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ উভয়ের দিক থেকে। একটি সুন্দর নদী একটি শহরকে তথা একটি দেশকে পাল্টে দিতে পারে। পরিবেশ রক্ষা,জাতীয় উন্নয়ন, ও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা শহরের নদীগুলো স্বাভাবিক হলে কী ও কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা আমার আলোচনার এ পর্বে তুলে ধরব।