Skip to main content

ঢাকা শহরের নদীগুলোর অবস্থা (১ম পর্ব)

ভূমিকা: ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। মাত্র ৫৯০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এই শহরকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ মানুষ শহরে আসা যাওয়া করে। আর বাংলাদেশের সব কিছু প্রানকেন্দ্র ঢাকা শহর। তাই প্রতিনিয়তই গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এভাবেই দিনদিন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলছে। ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ রাজধানী। বিরামহীনভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এক কালের সুন্দর ঢাকা শহর আজ পরিনত হয়েছে অপরিকল্পিত ও দূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যেভিক্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর হল ঢাকা।

ঢাকা শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি নদী দূষণ। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলো ধ্বংস হয়েছে তাই ঢাকা শহরে পরিবেশগত ও ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা দিনদিন বাড়বে। তাই মিডিয়া কিংবা সুশীল সমাজের কাছে কম আলোচিত বিষয়টি বর্তমানের অন্যতম বড় বিষয়। কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে মিডিয়ার কোন শক্ত অবস্থান দেখা যায় না আর সুশীল সমাজও বিষয়টি নিয়ে বেশি ব্যস্ত নয়। আর সাধারণ মানুষ নদীকে পাবলিক টয়লেটের মত ব্যবহার করে। প্রয়োজন পড়লে নদীর কাছে গিয়ে বলবে আহা নদীগুলো কি করুণ অবস্থা কিন্তু যখন তার প্রয়োজন পড়বে তখন সেই ব্যক্তিই নদী দূষণ করতে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। আমার ব্লগে ৫টি পর্বে লেখার মাধ্যমে ঢাকা শহরের নদীগুলো বর্তমান অবস্থা, এর কারণ, ফলাফল, এর প্রতিকার ও আইন এবং নদী দূষণ রক্ষায় বিভিন্ন মহলের কি ভূমিকা তা তুলে ধরব।

১ম পর্বের আজকের বিষয়: ঢাকা শহরের প্রধান নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা


ঢাকার চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই হচ্ছে ঢাকার লাইফ লাইন। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ঢাকার জনপদকে সুজলা-সুফলা এবং সুরক্ষিত নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর প্রবাহই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এসব নদীর সুপেয় স্বচ্ছ পানি কৃষির সেচ, বাণিজ্যিক পরিবহন এবং মৎস্যের উৎস হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষের চাহিদা পূরণ করে এসেছে। অথচ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলেছে। সেই সাথে অবাধে চলেছে নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানান তৎপরতা। বর্তমানে ঢাকা শহরের এসব নদীগুলো কি অবস্থায় আছে তা এ আলোচনায় তুলে ধরা হবে। এখানে ঢাকা শহরের আশেপাশের  প্রধান ৪টি নদীর বর্ণনা তুলে ধরা হল:

বুড়িগঙ্গা নদী : ঢাকা শহরের দক্ষিনে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদীটি। এক সময় বুড়িগঙ্গাকে বলা হত ঢাকার প্রাণ। কিন্তু আজ ঢাকা শহরের নদীগুলোর মধ্যে  বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এককালে স্বচ্ছ পানি প্রবাহী বুড়িগঙ্গার বর্তমান অবস্থা দেখলে যে কারো চোখে পারি চলে আসবে। পুরো ঢাকা শহরের সব কলকারখানা আর পয়ঃনিষ্কাষনের লাইনগুলো বুড়িগঙ্গায় এসে মিলেছে। বুড়িগঙ্গার এ মরণদশার বড় কারণ হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকারখানা। বর্তমানে এখানে প্রায় ২৫০টি ট্যানারি কারখানা আছে। এগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার প্রায় পুরোটাই নানাভাবে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। শীতকালে যখন নদীর পানি কমে যায় তখন অবস্থা এতটাই খারাপ যে, নদীর কাছে যেতেই বমির উদ্রেক হতে পারে। অন্যদিকে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর নদী দখল এবং দখল করা জায়গায় গড়ে তোলা শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে। কামরাঙ্গীরচর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত নদীর দুই পাশে পাড় বাঁধানো রয়েছে। কিন্তু দখলদাররা এ বাঁধানো পাড়েই গড়ে তুলেছে টংঘর। পূর্ব আগানগর এলাকায় বাঁধানো পাড়ের ওপর টংঘর তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় নর্দমার স্তূপ গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে নদীর অবস্থা খুবই করুণ এবং নদীর পানি দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত। এতে নদী পারাপারে যাত্রীদের যেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়, তেমনই বিষাক্ত ও কালো পানিতে মৎস্য, কীটপতঙ্গ ধ্বংস হচ্ছে প্রত্যহ। আর সাধারন মানুষ সচেতন না হয়ে তারাও ইচ্ছামত এখানে ময়লা, আবর্জনা, রাসায়নিক পদাথ ফেলছে। ফলে নদীটি হয়ে গেছে একটা বড়সড় নর্দমা। যত প্রকার ময়লা ও অপরিত্যাক্ত দ্রব্য আছে (ডাবের খোসা,বাসা বাড়ি ও ছোট ছোট ব্যবসার ময়লা, ডিমের খোসা, কলার খোসা, পলিথিন, ময়লা পানি, পশুপ্রানীর মল, মানুষের মল, কলকারখানা ও ইঞ্চিনের তেল ইত্যাদি) সব নদীতে ফেলা হয়। আর যেসব জিনিস ভাসমান তা ভেসে থাকে আর অভাস্যমান জিনিস নদীর তলদেশে গিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ও পানি দূষিত করেছে। এটা হচ্ছে সংক্ষেপে বুড়িগঙ্গার চিত্র। পুরো চিত্র তুলে ধরতে গেলে কয়েকটি বই লেখা যাবে।

বুড়িগঙ্গা নদীর একটি দৃশ্য

বালু নদী : রাজধানী ঢাকার উত্তর-পূর্ব এলাকায় নদীটি অবস্থিত। এটি বেলাই বিল ও ঢাকার উত্তর-পূর্ব বিস্তীর্ণ জলাভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে মিশেছে।  একসময়ের প্রাণবন্ত বালু নদ তার অস্তিত্ব হারানোর পথে। এখন নাব্য সঙ্কটে নৌকা চলাচলও কঠিন হয়ে পড়ছে। ৩৬ কিলোমিটারের এ নদের ২২ কিলোমিটার এলাকা এখন দখলদারদের আওতায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ নদটি ড্রেজিং না করায় এটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের প্রচন্ড খরস্রোতা এ নদটি এখন বছরে ছয় থেকে সাত মাসই পানিশূন্য অবস্থায় থাকে। এক কথায় বালু নদী এখন মৃত। বালু নদীর উপর ব্রীজ হবার কারণে নদীর ভিতরে ব্রীজের কয়েকটি পিলার নির্মান করা হয় । আর এজন্য নদীর পানির স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। নদীর দুই পাড়ে চর পড়ে ভরে গেছে। আর এজন্য নদীটিতে পানি প্রবাহ ক্ষীন হয়ে গেছে। নদীতে পানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি পানি এখন ময়লা যুক্ত। দিন যত যাচ্ছে নদীর পানিতে ময়লা, রাসায়নিক পদার্থ, আবর্জনা বাড়ছে। নদীটি বুড়িগঙ্গার মত দূষিত না হলেও এখন নদী থেকে মৃত খালে পরিনত হয়েছে।


বালু নদীর একটি দৃশ্য যা এখন মূলত খাল

শীতলক্ষ্যা নদী : ঢাকার আশপাশের চারটি নদীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী শীতলক্ষ্যা। এ নদী লক্ষ্মা নদী নামেও পরিচিত। এটি  ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদী। নারায়ণগঞ্জের পূর্বদিক দিয়ে কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীতে একসময় সারা বছর নাব্য থাকত। তখন এর সর্বোচ্চ প্রবাহ ছিল ঢাকার ডেমরার কাছে ২ হাজার ৬০০ কিউসেক। কিন্তু এখন আর সে অবস্থায় নেই। দখল-দূষণে ধ্বংসের পথে নদীটি। শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলারের ভেতর এখনও রয়ে গেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে বস্তিঘর ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনের অংশ। এছাড়া বছরের পর বছর চলছে বালুর ব্যবসা। নদীর সংযোগ খালগুলো ভরাট হওয়াই নদীর সাধারণ গতিপথ পরিবর্তন হতে চলছে। নদীর যা অবস্থা এটিও এখন খালে পরিণত হয়নি। তবে খালে পরিণত হতে সময় নেবে না। এখানে প্রতিদিনই মিশছে শিল্প কারখানার বিষাক্ত পরিত্যাক্ত বর্জ্য। আর নদীর পানি খুবই দুর্গন্ধযুক্ত ও বিষক্ত হয়ে গেছে। এছাড়া নদীর পাড় ক্রমেই ভরাট ও দখল হচ্ছে। ফলে এই নদীটিও বুড়িগঙ্গার অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকে নদী পাড় হতে গেলে নদীর পানির দুর্গন্ধের চোটে নাকে রুমাল দিতে হয়। নদীতে অবিরামভাবে অপরিত্যাক্ত ময়লা ও শিল্প কারখানার পরিত্যাক্ত বজ্য ফেলা হচ্ছে। যা নদীর পানিকে দুগন্ধ ও বিষাক্ত করেছে।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাশের চিত্র
তুরাগ নদী: টাঙ্গাইলের উজানে লৌহজং নদী ভাটিতে এসে তুরাগ নাম ধারণ করলেও এটি বংশী নদীর শাখা। টাঙ্গাইল জেলা থেকে এসে দরিরামপুরের কাছে ঢাকা জেলায় প্রবেশ করেছে নদটি। এটি কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, গাজীপুর, সাভার, মিরপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহাম্মদপুরের ভেতর দিয়ে বুড়িগঙ্গায় এসে মিশেছে। দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার ও প্রস্থ ২১৮ মিটার। গভীরতা ১৩.৫ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ১ হাজার ২১ বর্গকিলোমিটার। তুরাগ নদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে নদটি। একসময় সারা বছরই এ নদের প্রবাহ থাকত। কিন্তু এখন তুরাগ তার ঐতিহ্য হারিয়ে ছোট খালে পরিণত হয়েছে। অনেক জায়গায় বাঁধ দিয়ে নদের গতিপথ রোধ করে রেখেছে অনেকে। দখলদার ও শিল্প মালিকদের কবলে পড়ে দখল-দূষণে মরতে বসেছে নদটি। নদীর পাশেই গড়ে ওঠেছে ভারী শিল্প কারখানা ও ইট ভাটা আর এসবে বর্জ পদার্থ বিনা বাধায় নদীতে ফেলছে ফলে নদীর পারি বিষাক্ত হয়ে গেছে। আর নদীর উপর দিয়ে একটি ব্রীজ হওয়ায় পানি প্রবাহ ক্ষীন হয়ে গেছে। এটা এখন মৃত একটি খালে পরিনত হয়েছে।

তুরাগ নদীর নোংরা পানির প্রবাহের দৃশ্য
 এই পর্বে ঢাকা শহরের প্রধান ৪টি নদীর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে ২য় পর্বে নদীগুলো দূষণের কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


Comments

Popular posts from this blog

ঢাকা শহরের নদী দূষণের ফলাফল (৩য় পর্ব)

আমাদের ঢাকা শহরের চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বে এমন রাজধানী বিরল। এক সময় ঢাকা শহরে ছিল পরিবেশ বন্ধব। অনেক গাছপালা ছিল আর ঢাকা শহরের ভিতরের ছোট ছোট খালগুলো ছিল দূষণমুক্ত। মানুষ আরামে বসবাস করতে পারত। বর্তমানে সেই নদীগুলোকে ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু প্রাণহীন এই নদীগুলো ধ্বংস হলে আমাদের কি কোন ক্ষতি হবে না? নদীগুলো হত্যা করে আমরা কি শান্তিতে বাচতে পারব? না, নদীগুলো ধ্বংস করে আমরা শান্তিতে বাচাতে পারব না। কারণ এই নদীগুলো ছিল আমাদের জীবনকে সুন্দর করার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ না থাকলে বা বিপন্ন হলে মানব জীবনে ও পরিবেশের উপর এর ফলাফল কি হবে পারে তাই আমরা এ পর্বে আলোচনা করব।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর রক্ষা সুফলগুলো (৫ম ও শেষ পর্ব)

আমরা যদি বিশ্বে মানচিত্রের দিকে তাকাই তবে দেখব বিশ্বের সব গুরুত্বপূণ শহরগুলো নদী কিংবা সমুদ্রের তীর অবস্থিত। আমরা যদি এবার ইতিহাসে দিকে তাকাই তবে দেখব সেসব শহরের পাশে নদী আছে সেই সব শহরগুলো অন্য শহরগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ এটা যোগাযোগ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ উভয়ের দিক থেকে। একটি সুন্দর নদী একটি শহরকে তথা একটি দেশকে পাল্টে দিতে পারে। পরিবেশ রক্ষা,জাতীয় উন্নয়ন, ও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা শহরের নদীগুলো স্বাভাবিক হলে কী ও কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা আমার আলোচনার এ পর্বে তুলে ধরব।