Skip to main content

ঢাকা শহরের নদীগুলোর করুণ পরিনতির কারণ (২য় পর্ব)

 ঢাকা শহরের আশেপাশে নদীতে এক সময় ছিল স্বচ্ছ পানি। নদীগুলো তার নিজ গতিতে বয়ে যেতে। মানুষ নদীর পানি বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত এমনকি সেই পানি মানুষ খেত ও রান্নার কাজে ব্যবহার করত। অবসর সময় শহরের মানুষেরা নদীগুলোতে নৌকায় করে ঘুরত। মানুষ ক্লান্তি দূর করতে নদী পাড়ে দাড়িয়ে বিশুদ্ধ বাতাস নিত। কিন্তু এসব কথা এখন ইতিহাস। সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে নদীগুলোও কিন্তু নদীগুলো পাল্টেতে চাই নি। আমরাই আমাদের স্বার্থে পাল্টে ফেলেছি নদীগুলো। নদীগুলোর এই নেতিবাচক পাল্টানোর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী মানুষ জাতি। আমরা পারতাম নদীগুলোকে আর সুন্দর করতে কিন্তু তা না করে নদীগুলোকে ধ্বংস করেছি। ঢাকা শহরের আশেপাশের নদীগুলোকে নিয়ে লেখার ২য় পর্বে নদীর করুণ অবস্থার কারণগুলো তুলে ধরবে।

১. শিল্পের বর্জ্য পদার্থ:
ঢাকা শহরের আশেপাশে নদীগুলো পানি দূষনের জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে শিল্পের বর্জ্য পদার্থ। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা, সিমেন্ট কারখানা, ট্যানারি শিল্প, ওষুধ শিল্প, জাহাজ শিল্পসহ ভারী ভারী শিল্প কারখানা এসব কারখানার পরিত্যাক্ত পদার্থগুলো নদীতে ফেলছে। ফলে এগুলো নদীর পানি দূষিত, দূগন্ধ ও বিষাক্ত করছে। বুড়িগঙ্গার পানি দূষনের জন্য হাজারীরাগের ২৭০টিও বেশি ট্যানারিকে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বলা হয়। কারণ এই শিল্পের জন্য প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক বিষাক্ত বর্জ্য পানিতে মিশে।

২. পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য:
নদীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যবসা জমে উঠে। তাই এসব নদীগুলোর পাড়েও বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা ঘটে উঠেছে। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য নদীতে ফেলছে। যেমন. পাচা আলু, আপেল, পিয়াজ,তরমুজ,আনাসর,মৃত মুরগি, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য নদীতে ফেলছে। অন্যদিকে পলিথিন, টায়ার, ডিমের খোসা, কাচ ভাঙ্গা,কাঠসহ বিভিন্ন অপচনশীল দ্রব্যও নদীতে ফেলছে ফলে এসব পদার্থের জন্য নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

৩. ময়লা ও আবর্জনা:
নদীতে বসত বাড়ির আবর্জনা থেকে শুরু করে শিল্প কারখানার ময়লা আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলছে। ময়লাকর্মীরা, সাধারন মানুষ সবাই নিজেদের সুবিধামত স্থানে ময়লা ফেলে দায়িত্ব শেষ বলে বেচে যায়। ময়লা ও আবর্জনা একদিকে নদীর পানি দূষিত করছে অন্যদিকে নদীর ভরাট করছে।

 ৪. নদীর পাড়ে বিভিন্ন ব্যবসা:
নদী পাড়গুলোতে গড়ে উঠেছে নৌকাঘাট, লঞ্চঘাট, বালুর ব্যবসা প্রভৃতি। সদরঘাটের শত শত লঞ্চের তেল ও ইঞ্জিনের ময়লা পানি নদীতে মিশে নারীর পানি দূষিত করছে। বালুর ব্যবসার জন্য শীতলক্ষ্যার নদীর অবস্থা আজ হুমকির মুখে। এছাড়া নৌযানের ধাক্কায় নদীর পাড় ভেঙ্গে যায় ও লঞ্চের পাখায় মাধ্যমে নদীর নিচের ময়লা পানিকে আরও ময়লা করে।

৫.ক্ষমতাসীনদের দখলে নদী ও নদীর পাড়:
 ঢাকা শহরের নদীগুলোর আজকের করুণ দশার জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে নদীগুলোর দখলকারীরা। অবৈধভাবে তারা নদীর পাড় দখল করে সেগুলো নিজেদের মত করে ব্যবহার করছে। দখলদারীরা এসব জায়গা ভাড়া দেয় ছোট ছোট ব্যবসার জন্য। ভাড়া নিয়ে কেউ নদী পাড়ে গড়ে তোলে চায়ের দোকান আর চায়ের ময়লা, কলার খোসা সরাসরি ফেলছে নদীতে। খাবার হোটেল দিয়ে হোটেলের পরিত্যাগ জিনিসগুলো ফেলেছে নদীতে। ঢাকা শহরের প্রতিটি নদীতে একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এসব জিনিস পচে গলে পানি দূষিত করে, ছড়ায় দুগন্ধ। এছাড়া দখলকারীরা নদীর পাড় ভরাট করে নিজেরদের স্থায়ী সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে। এভাবে একদিকে নাদীর আয়তন ও নাব্যতা কমে অন্যদিকে নদীর পানি দূষিত হয়। যুগান্তরের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিনপাড়ের আটি, খোলামোড়া থেকে শুরু করে জিনজিরা, কালিগঞ্জ হয়ে পারগেন্ডরিয়া হাসনাবাদ ও কামরঙ্গীরচর এলাকায় পাঁচশ’র বেশি বসতি বাড়ি গড়ে উঠেছে। এবং এসব বসতি বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা সরাসরি নদীর সাথে। এই একই চিত্র শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পাড়েও বিদ্যমান।

৬. সরকারের অব্যবস্থাপনা ও নিরবতা:
বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতি করে কিছু পাওয়ার জন্য কিন্তু যারা রাজনীতি করে তাদের সংখ্যা অনেক তাদেরকে দেবার মত জিনিস সরকার ও দলগুলো শেষ হয়েছে গেছে। যেমন. বাসের ব্যবসা, রাস্তা নির্মানের কাজ প্রভৃতি। ফলে এখন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতা কর্মীদের নদী খাল বিল দিয়ে দিচ্ছে। ফলে সরকারী দলের লোকজন সরকারী সম্পত্তি হিসেবে নিজেদের মত নদীগুলো দখল দূষণ করে । উদ্দেশ্য একটাই নদীকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জন। ফলে সরকারের নেতাকর্মীরা নদীকে দূষণ ও দখল করলে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। এটা নদী দূষণের অন্যতম কারণ।

৭. নদী দূষণে সাধারণ মানুষদের অংশগ্রহণ:
শুধু ক্ষমতাসীন কিংবা কলকারখানার মালিকরাই নদী দূষণের জন্য দায়ী নয়। সাধারণ মানুষও সচেতন ও অসচেতনভাবে নদী দূষণে অংশ নেয়। সাধারণ মানুষ তাদের অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নদীর পানিতে ফেলে দিতে নিজের দ্বায় শেষ বলে মনে করে আর ক্ষমতাসীন ও শিল্প মালিকদের দায়ী করে। কিন্তু দেখা যায় তারাও তাদের মত করে নদী দূষণ করছে।

 ৮. আইনের প্রয়োগ নেই:
বাংলাদেশে সব অপরাধের জন্য আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ আছে এমন ক্ষেত্রগুলো গবেষনা করে বের করতে হবে কারণ এতই বিরল। আর আইনের যে প্রয়োগ নেই তা বোঝা যাবে বুড়িগঙ্গার করুণ অবস্থা দেখলেই। বুড়িগঙ্গা হঠাৎ করেই এমনভাবে দূষিত হয়নি। এটা একদিনে ঘটে নি। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এই দূষণের বিরুদ্ধে তেমন কোন আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। ফলে দূষণকারীরা মনে সুখে নির্ভয়ে নদী দূষণ ও দখলের কাজ চালিয়ে গেছে আর দুঃখের বিষয় হল এখনও চলছে। 

৯. প্রকল্পের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করে না:
নদীকে রক্ষা করার জন্য সরকারের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও নদী রক্ষার জন্য বড় অংকের টাকা বাংলাদেশকে দিয়েছে। কিন্তু কোন ধরণের প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পের কাজ থেমে গেছে কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। ফলে নদীর উন্নয়ন ও রক্ষা কোনটিই হয়নি। আর দূষণ বন্ধ না হলে কিংবা তা প্রতিরোধের জন্য কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে দূষণের পরিমান বেড়ে যাবে দিনদিন। আর সেটাই হয়েছে।

১০. দুর্নীতি:
নদী রক্ষার সাথে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত সেগুলো হল: নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়, ভূমি ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়, ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন ও বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দুনীর্তি আখড়া হিসেবে পরিচিত। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম দুর্নীতির হাতিয়ার হল নদী ও পানি। আর তারা নদী ও পানিকে ব্যবহার করতে গিয়ে এগুলোকে দূষিত ও বিষক্ত করেছে। অন্যদিকে তাদের যে ভূমিকা ছিল তা পালন না করে নিরব ভূমিকা পালন করছে। ফলে তারা তাদের লাভের জন্য নদীগুলোকে তথা ঢাকা শহরকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

১১. অপরিকল্পিত নগরায়ন

ঢাকা শহরের ইচ্ছামত দালাল রাস্তা তৈরি হয়েছে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে এই শহরটি গড়ে না ওঠায় নদীগুলোর আজ এই মরনদশা। এটাও অন্যতম প্রধান কারণ

ঢাকা শহরের নদীগুলো দূষণের প্রধান কারণগুলো এগুলোই। আগামী পর্বে  ঢাকা শহরের নদী দূষণের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করব।


শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকা শহরের নদী দূষণের ফলাফল (৩য় পর্ব)

আমাদের ঢাকা শহরের চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বে এমন রাজধানী বিরল। এক সময় ঢাকা শহরে ছিল পরিবেশ বন্ধব। অনেক গাছপালা ছিল আর ঢাকা শহরের ভিতরের ছোট ছোট খালগুলো ছিল দূষণমুক্ত। মানুষ আরামে বসবাস করতে পারত। বর্তমানে সেই নদীগুলোকে ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু প্রাণহীন এই নদীগুলো ধ্বংস হলে আমাদের কি কোন ক্ষতি হবে না? নদীগুলো হত্যা করে আমরা কি শান্তিতে বাচতে পারব? না, নদীগুলো ধ্বংস করে আমরা শান্তিতে বাচাতে পারব না। কারণ এই নদীগুলো ছিল আমাদের জীবনকে সুন্দর করার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ না থাকলে বা বিপন্ন হলে মানব জীবনে ও পরিবেশের উপর এর ফলাফল কি হবে পারে তাই আমরা এ পর্বে আলোচনা করব।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর অবস্থা (১ম পর্ব)

ভূমিকা:  ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। মাত্র ৫৯০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এই শহরকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ মানুষ শহরে আসা যাওয়া করে। আর বাংলাদেশের সব কিছু প্রানকেন্দ্র ঢাকা শহর। তাই প্রতিনিয়তই গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এভাবেই দিনদিন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলছে। ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ রাজধানী। বিরামহীনভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এক কালের সুন্দর ঢাকা শহর আজ পরিনত হয়েছে অপরিকল্পিত ও দূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যেভিক্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর হল ঢাকা।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর রক্ষা সুফলগুলো (৫ম ও শেষ পর্ব)

আমরা যদি বিশ্বে মানচিত্রের দিকে তাকাই তবে দেখব বিশ্বের সব গুরুত্বপূণ শহরগুলো নদী কিংবা সমুদ্রের তীর অবস্থিত। আমরা যদি এবার ইতিহাসে দিকে তাকাই তবে দেখব সেসব শহরের পাশে নদী আছে সেই সব শহরগুলো অন্য শহরগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ এটা যোগাযোগ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ উভয়ের দিক থেকে। একটি সুন্দর নদী একটি শহরকে তথা একটি দেশকে পাল্টে দিতে পারে। পরিবেশ রক্ষা,জাতীয় উন্নয়ন, ও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা শহরের নদীগুলো স্বাভাবিক হলে কী ও কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা আমার আলোচনার এ পর্বে তুলে ধরব।