Skip to main content

ঢাকা শহরের নদী রক্ষার বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিভিন্ন মহলের ভূমিকা (৪র্থ পর্ব)

বাংলাদেশের স্বাক্ষরতার হার ৫৬% । আর মাধ্যমিক পাশ করছে লোকসংখ্যার হার ৩৫%। পরিসংখ্যানের দুটি তথ্য তুলে ধরলাম এ জন্য যে আমাদের দেশে প্রকৃত শিক্ষিতের হার বেশি নয় এবং এখানে দারিদ্রতা হারও অনেক। তাই মানুষ পরিবেশ সচেতন নয় ও নিজের স্বার্থে পরিবেশকে ব্যবহার করে। এসব বিষয় নদী সমস্যার পদক্ষেপের জন্য অন্যতম বাধা কিন্তু এসব বিষয় মাথায় না রেখেই উপর থেকে কতৃপক্ষ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফলে সেসব সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হয় না। কোন পদক্ষেপ বা সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন সেই সমস্যার সাথে জড়িত সকল অংশিদারদের সাথে আলোচনা করা। ঢাকা শহরের নদীগুলোকে রক্ষার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়ই এই পর্বে আলোচনা করব।


১. আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ:
সমাজের কোন বিশৃঙ্গলা দেখা দিলে আমরা আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকি। আইনের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে থাকি। নদী দূষণের সাথে অনেক অসৎ ও কুচক্রী মহল জড়িত আছে। তারা নদীকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করে। তারা এজন্য নদীকে তারা ধ্বংস করে, দূষণ করে। তাই এসব বন্ধের জন্য শক্ত আইনের বিধান করা জরুরি। এসব আইন থাকলেই হবে না তার যথাযথ প্রয়োগও করতে হবে। এটা করা সম্ভব হলে মানুষ নদীকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। আর নদীগুলো তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে।

২. সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ:
একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। তাই সরকার ইচ্ছা করলে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে আবার সমস্যা তৈরিও করতে পারে। ফলে সরকার যদি নদী রক্ষার জন্য বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রকল্প গ্রহণ করে ও তা বাস্তবায়ন করে তবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

৩. দুর্নীতি বন্ধ:
আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা হল দুর্নীতি। ফলে নদী রক্ষার প্রকল্পগুলোতেও যদি দুর্নীতি হয় তবে প্রকল্প সফল হবে না। আর বাস্তবে এটাই বেশি দেখি। প্রকল্প নেওয়া হয় কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয় না। প্রকল্পের উল্লেখ্যযোগ্য টাকা এর সাথে ‍যুক্ত ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করে। ফলে দুর্নীতি রোধ না করতে পারলে নদী রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
  
৪. মিডিয়ার ভূমিকা:
মিডিয়া রাজনীতি নিয়েই বেশি মাতামাতি করে ঢাকা শহরের নদী দূষনের মত গুরুত্বপূণ বিষয় তারা খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। যেদিন কোন সংবাদ থাকে না সেদিন দিনে যে সময়ে কম দর্শক দেখে সে সময়ে নদীর উপর ছোট প্রতিবেদন দেখানো হয়।  ব্যাপার সম্পূণ দায় সাড়া। কারণ মিডিয়ার ব্যবসায়ীও নদী দূষণের সাথে জড়িত তাই তারা চায় না এ সমস্যাটির সমাধান হোক। কিন্তু মিডিয়া স্বেচ্ছার না হলে নদী দূষনের মত বড় সমস্যার সমাধান কঠিন। কারন এ সমস্যার সাথে অনেক মানুষ জড়িত। সবাইকে সচেতন করার কাজটি মিডিয়া যত ভালভাবে করতে পারে আর কেউ করতে পারবে না।

৫. সুশীল সমাজের ভূমিকা:
সুশীল সমাজ নদী রক্ষার জন্য গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তারা নদীর এসব সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে, জরিপ করে। তাই তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। জ্ঞানের দিকে থেকেও তারা অন্যান্য শ্রেনীদের থেকে অগ্রসর ফলে তাদের জোরালো লেখা কিংবা বক্তব্য সরকার, মিডিয়া, জনগন সবাই এই সমস্যা সমাধানের আরও বেশি সচেতন করে তুলেবে।

৬. সাধারণ মানুষের ভূমিকা:
সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্ট্রে সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে সরকার। তাদের কোন দায়িত্ব নেই কিন্তু তাদেরও দায়িত্ব আছে। দেশে আমাদের নদী আমাদের তাই এসব ধ্বংস হলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হব সরকার নয়। তাই প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে অন্যদিকে কেউ কোন অন্যায় করলে নদী দূষণ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। কারণ সরকার প্রতি সেকেন্ড নদীর তীরে বসে থাকবে না। জনগনই নদীর আশেপাশে সব সময় থাকে। তাই নদী রক্ষা সাধারণ মানুষের ভূমিকাও কম নয়।

৭. দূষণের কারণগুলো চিহ্নিত ও তার সমাধান:
আমরা জানি বালু ও তুরাগ নদীর তীরে ব্রীজ হবার জন্য নদী দুটি মরে গেছে। যদি ব্রীজ না হত কিংবা অন্য ডিজাইনের ব্রীজ হত তবে নদী দুটি বেচে যেত। এই বিষয়গুলোও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। হাজারীবাজারের ট্যানারি শিল্পের সাথে অনেক মানুষ জড়িত অনেক ক্ষমতাসীনরাও এই ব্যবসা করে তাই সে ব্যবসা বন্ধ না করে দিয়ে যাতে অন্য জায়গা স্থানন্তর করে পারে সে ব্যবস্থা করা।

৮. নদীর পাড় ও পানি রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প:
একই সাথে নদীর বড় প্রাকৃতিক বিষয়কে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় সব কিছুকে ঠিক করার জন্য। এ বিষয়টি পরিবতন করে একটি একটি করে সমস্যার সমাধান করার প্রকল্প গ্রহণ।

৯. দীঘমেয়াদী প্রকল্প:
বেশির ভাগ প্রকল্পই থাকে কয়েক মাসের জন্য। কিন্তু নদীকে সত্যিকার অর্থে দূষন মুক্ত করতে প্রয়োজন কয়েক বছর মেয়াদী প্রকল্প।
১০. প্রকল্পের সাথে স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ততা:
মন্ত্রনালয়ে বসে বাস্তবধর্মী প্রকল্প গ্রহণ করা অনেক সময় সম্ভব নয়। তাই স্থানীয় মানুষদের কথা শুনতে হবে। তাদেরকে প্রকল্পের সাথে যুক্ত করতে হবে। নদীগুলো কি সমস্যা কারা দায়ী, তারা নদী ধ্বংস করছে কেন, সঠিক সমাধান কি হতে পারে। এসব প্রশ্নের বাস্তব নিভর তথ্য নদী রক্ষা করতে সহায়তা করবে।

১১. নদী রক্ষায় প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে ব্যবহার:
বতমান যুগ তথ্য প্রযুক্তি যুগ। আমাদের দেশ প্রযুক্তি ও যন্ত্রের দিক থেকে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও নদী ড্রেজিং করার ভাল যন্ত্র নেই। কিছু থাকলেও তা সীমিত। কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীর পানি টেস্ট করে তা বিশুদ্ধ করে কোন মেডিসিন আবিষ্কার করা। এর ফলে নদীকে রক্ষা করা সহজ হবে। এছাড়া কোন অন্যায় করলে তা জানাতে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটকে ব্যবহার করতে পারে। নদী দূষনের গুরুত্বপূন জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে দিতে পারে। ফলে মানুষ ভয়ে হলেও নদীকে দূষণ থেকে বিরত থাকবে।

১২. নদী রক্ষার সাথে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তা:
নদী রক্ষার সাথে কয়েক মন্ত্রনালয় আছে ও সুশীল সমাজের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও আছে। তাদেরকে অব্যাহতভাবে নদী রক্ষায় কাজ করতে হবে। মিডিয়াতে চেহারা দেখাতে কিংবা বিশ্ব নদী দিবসে বড় বড় বানী দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে  না দেওয়া।

উপরের পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলে ও বাস্তবায়ন হলে নদীগুলো তার স্বাভাবিক রূপ ফিরে পাবে। আমরা আবার হয়ত নদীতে বিশুদ্ধ পানি দেখতে পাব। আগামী পর্বে নদীগুলো তা স্বাভাবিক রূপ ফিরে পেলে ঢাকাবাসীর কি কি সুবিধা হবে সে বিষয়টি তুলে ধরব।


শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


Comments

Popular posts from this blog

ঢাকা শহরের নদী দূষণের ফলাফল (৩য় পর্ব)

আমাদের ঢাকা শহরের চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। বিশ্বে এমন রাজধানী বিরল। এক সময় ঢাকা শহরে ছিল পরিবেশ বন্ধব। অনেক গাছপালা ছিল আর ঢাকা শহরের ভিতরের ছোট ছোট খালগুলো ছিল দূষণমুক্ত। মানুষ আরামে বসবাস করতে পারত। বর্তমানে সেই নদীগুলোকে ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু প্রাণহীন এই নদীগুলো ধ্বংস হলে আমাদের কি কোন ক্ষতি হবে না? নদীগুলো হত্যা করে আমরা কি শান্তিতে বাচতে পারব? না, নদীগুলো ধ্বংস করে আমরা শান্তিতে বাচাতে পারব না। কারণ এই নদীগুলো ছিল আমাদের জীবনকে সুন্দর করার অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদ না থাকলে বা বিপন্ন হলে মানব জীবনে ও পরিবেশের উপর এর ফলাফল কি হবে পারে তাই আমরা এ পর্বে আলোচনা করব।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর অবস্থা (১ম পর্ব)

ভূমিকা:  ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। মাত্র ৫৯০ বর্গ মাইলের ছোট্ট এই শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। এই শহরকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ মানুষ শহরে আসা যাওয়া করে। আর বাংলাদেশের সব কিছু প্রানকেন্দ্র ঢাকা শহর। তাই প্রতিনিয়তই গ্রাম থেকে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এভাবেই দিনদিন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়ে চলছে। ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ রাজধানী। বিরামহীনভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এক কালের সুন্দর ঢাকা শহর আজ পরিনত হয়েছে অপরিকল্পিত ও দূষণের নগরী হিসেবে পরিচিত। ঢাকা শহর এখন বিশ্বের অন্যতম অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যেভিক্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহর হল ঢাকা।

ঢাকা শহরের নদীগুলোর রক্ষা সুফলগুলো (৫ম ও শেষ পর্ব)

আমরা যদি বিশ্বে মানচিত্রের দিকে তাকাই তবে দেখব বিশ্বের সব গুরুত্বপূণ শহরগুলো নদী কিংবা সমুদ্রের তীর অবস্থিত। আমরা যদি এবার ইতিহাসে দিকে তাকাই তবে দেখব সেসব শহরের পাশে নদী আছে সেই সব শহরগুলো অন্য শহরগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ এটা যোগাযোগ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ উভয়ের দিক থেকে। একটি সুন্দর নদী একটি শহরকে তথা একটি দেশকে পাল্টে দিতে পারে। পরিবেশ রক্ষা,জাতীয় উন্নয়ন, ও আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা শহরের নদীগুলো স্বাভাবিক হলে কী ও কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা আমার আলোচনার এ পর্বে তুলে ধরব।